নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে হওয়ার সুবাদে অনিয়ম-দুর্নীতির ‘বরপুত্র’ ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে একতরফা জয় পান সাদিক।
পরের বছর মহানগর আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন তিনি।মেয়র ও পদ বাগিয়ে নিয়ে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের অফিস থেকে মূল্যবান আসবাপত্রসহ মালামাল তার নিজ বাসায় নিয়ে যান।মেয়র হওয়ার পর তার বাসাকে বানিয়েছেন অফিস।যেখানে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মৃত্যুর হয়। সাদেকের বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়।
তার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্বেও বরিশাল সড়ক ও জনপথ এর রাস্তা দখল করে অবৈধভাবে জনগনের টাকায় মায়ের নামে বরিশাল চৌমাথায় মহাসড়কে পার্ক তৈরী করে।সেটা ছিল সম্পূর্ন অবৈধ।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণ দেখিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া, জরিমানার নামে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন দাবি, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট দাবি, রাজনৈতিক বিরোধীদের মারধর, কথায় কথায় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করাসহ বহু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে সাদিকের বিরুদ্ধে।
তার নির্দেশে না চললে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জেল পর্যন্ত খাটাতে হয়েছে অনেককে। পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, বরিশাল ক্লাবও অবৈধভাবে দখল করেছেন তিনি।
সেখানে তিনি এক এসি পাঁচ বছরের জন্য একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি এমনটি জানিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার।কিন্তু এত কিছুর পরেও কেউ টু শব্দ করতে পারেনি তার বিরুদ্ধে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে সার্বক্ষণিক ঘিরে রাখতেন তাঁর ছয় সঙ্গী।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তাঁরা মেয়রের প্রিয়জন।আলোচিত-সমালোচিত ছয় নেতা হলেন– মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল, মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইছ আহমেদ মান্না, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিকুল্লাহ মুনিম ও সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত এবং জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজিব হোসেন খান।
তাঁদের মধ্যে বর্তমান দুই কাউন্সিলর ছাড়াও মান্না ও সাজ্জাদ কাউন্সিলর প্রার্থী হতে এক বছর আগেই মাঠে নামেন।যাদের দিয়ে পুরো বরিশাল নিয়ন্ত্রন করতেন চাঁদাবাজি থেকে ফ্লাট দখল। গত পাঁচ বছর বরিশাল নগরীতে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, নগর ভবনে সেবা নিতে আসা নাগরিককে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়সহ নানা অপকর্মের হোতা ছিলেন তাঁরা।
নিরব হোসেন টুটুল সাদিক যুগে তিনি মহানগরে শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক পদ পেয়ে যান। তাঁর পরিচিতি ছিল মেয়র সাদিকের ‘ক্যাশিয়ার’। নগরের সব হাট-বাজার, মৎস্যবন্দর, নৌবন্দর, বাস টার্মিনালের ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ইজারাদার হন তিনি।বৈধ অবৈধভাবে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক।
সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হওয়ার পর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান তখনকার পদহীন ছাত্রলীগ নেতা রইছ আহমেদ মান্না। একপর্যায়ে তিনি তিনটি বাসের মালিক হয়ে জেলা বাস মালিক সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য হন।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধন শাখা ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে।যার নিয়ন্ত্রনে ছিল বরিশাল মহানগরীর মাদক নিয়ন্ত্রনে। ভর্তি-বাণিজ্যসহ কলেজের আর্থিক-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তাঁর মাধ্যমে হয়। কলেজের সাত পুকুরের তিনটিতে মাছ চাষের বাণিজ্য করছেন মুনিম।
২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দিনদুপুরে মুখোশ পরে একদল যুবক সমাজকর্ম বিভাগে হামলা এবং কর্মচারী মিজানুর রহমান বাচ্চুকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনার মূল হোতা এই মুনিম।
বিসিসির সড়ক পরিদর্শক হিসেবে ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাতের নিয়োগের পরে অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে গোটা নগরে ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।পভিযোগ আছে অবৈধভাবে সিটি কর্পোরেশনের স্টল দখল করার।
মেয়রের আস্থাভাজন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ সাঈদ আহমেদ মান্নাও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।নগরের চৌমাথায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দখল করে পার্ক নির্মাণের ইন্ধনদাতা ছিলেন মান্না। ঠিকাদারও ছিলেন তিনি।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মেয়র এবং সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন সাদিক আবদুল্লাহ। তার অনুগতরা পান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদপদবি। তার বিরোধিতা করলে শুধু অপমান, হয়রানি, মামলা নয়, নকশাবহির্ভূত নির্মাণের অভিযোগ তুলে বাড়িতে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার চালানোর ভয়ে সবাই চুপ থাকতেন।
দলীয় মনোনয়ন তার আপন চাচাকে দিলে সাবেক সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘বরিশাল মুক্ত হয়েছে। বরিশালে অনেক অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও সন্ত্রাস হয়েছিল। বরিশালের মানুষ অনেক কষ্টে এই দিনগুলো অতিবাহিত করেছে।
তার নিজ দলীয় নেতা কর্মীরা বলেন সাদিক মেয়র থাকাকালীন বরিশালে যারাই ভবন নির্মাণ করেছে, তাদের কাছে কমিশন হিসেবে ফ্ল্যাট অথবা ফ্লোর চাইতেন তিনি। না দিলে সিটি করপোরেশনের লোক পাঠিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতেন। এমনকি নিজের মামার নির্মাণাধীন পাঁচতলা ভবনেও অংশীদারত্ব চেয়েছিলেন সাদিক। রাজি না হওয়ায় ভবনটি নকশা মেনে হচ্ছে না অভিযোগ দিয়ে চারপাশ থেকে ১০ ফুট করে ভেঙে দেয় সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের নামে প্রায়শই চোখ ধাঁধানো প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে সেগুলোর অধিকাংশই ছিল কাগুজে ও দুর্নীতিপূর্ণ। ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তা সংস্কার, বিদ্যুৎবাতি স্থাপন, এমনকি ময়লা ব্যবস্থাপনাতেও দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট বলে অভিযোগ নগরবাসীর। অভিযোগ আছে সাদেক মেয়র থাকা কালিন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে জার্মান প্রকল্প্রের কাজ না করে কয়েক কোটি টাকা আত্নসাত করে বলে জানান বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা।
বিভিন্ন সময়ে টেন্ডার বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, ও অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে। অনেক ঠিকাদার এবং কর্মচারী চুপ থাকলেও সম্প্রতি বদলির পর ভেতরের খবর ফাঁস হতে শুরু করে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ব্যয়ের অস্বাভাবিক ব্যবধান, যা একাধিক তদন্তকারী সংস্থার নজরে এসেছে।
https://slotbet.online/